Sunday, February 22, 2009

Bangladeshi Manipuris in The 21st February 2009 (Ekushey February)





























নুপী লান বা নারী বিদ্রোহ-এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য

নুপী লান বা নারী বিদ্রোহ-এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য


১৮৯১ সালের ২৫ এপ্রিল খোংজোম তীরে ইঙ্গ-মনিপুরি যে যুদ্ধ হয় তাতে পরাজিত হয় মনিপুর বাহিনী এবং এর তৃতীয় দিনেই অর্থাৎ ২৭ শে এপ্রিল তারিখে মনিপুর রাজ্য পুরোপুরিভাবে বৃটিশ শাসনের অন্তর্গত হয়। মহারাজ কুলচন্দ্র সিংহ ২০০ অনুচরসহ চীনদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্ট করেন। কিন্তু কতিপয় সহযোগীর বিশ্বাসঘাতকতায় বন্দী হন বৃটিশদের হাতে। অচিরেই ধরা পড়েন বীর টিকেন্দ্রজিৎ এবং থাঙ্গাল জেনারেলকে বৃটেনের মহারানীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অপরাধে বিচার করে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় যা ১৮৯১ সালের ১৩ই আগষ্ট তারিখে প্রকাশ্য জনসমক্ষে পোলো গ্রাউন্ডে কার্যকর করা হয়। এর আগে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে এন. সুবেদার, কাজাও সিংহ এবং জেনারেল থাঙ্গালকেও ফাঁসি দেয়া হয়। আবার অনেককে দেয়া হয় নির্বাসন। এভাবেই স্বাধীন মনিপুরের একচ্ছত্র শাসনক্ষমতা দখল করে নেয় বৃটিশ সরকার।

মনিপুর বৃটিশ শাসনের অধীন হলেও বৃটিশ শাসিত ভারতের সাথে একীভূত হয়নি বরং স্বতন্ত্র মর্যাদা নিয়ে তার অবস্থান অক্ষুন্ন রাখে। কিন্তু মনিপুরের শাসনব্যবস্থা বৃটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশ-আদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হতে থাকে। মাত্র ৫ বছর বয়সী রাজপুত্র চূড়াচান্দ'কে রাজসিংহাসনে বসানো হয়। মনিপুরি প্রজাবৃন্দ এসময় নানা সমস্যাদির মুখোমুখি হতে থাকে।

১৮৯১ সালের ২১ আগষ্ট, বৃটিশ সরকার মনিপুর শাসনের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা ঘোষণা করে কিন্তু মনিপুরি প্রজাবৃন্দ তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে বৃটিশরা মনিপুরি সৈন্যদের উপযুক্ত অস্ত্র-শস্ত্র না দিয়ে আলাদা করে রাখে এবং বৃটিশ সৈন্যদের আজ্ঞাবাহী করে রাখে। মনিপুরি সৈন্যদের 'খুজুমা' থেকে 'কোহিমা' পর্যন্ত দীর্ঘ ৭২ মাইল রাস্তায় বিনা পারিশ্রমিকে বৃটিশ সৈন্যদের রেশন বহন করার কাজে নিয়োজিত করে। শুধু তাই নয়, নানাবিধ কায়িক শ্রমে মনিপুরিদের নিয়োজিত করে। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মনিপুরিদের কাছ থেকে ২,৫০,০০০ টাকা আদায় করে। এমনকি মনিপুরি প্রজাদের উপর মাথাপিছু সমতলে ২ টাকা এবং পাহাড়ে ৩ টাকা করে ট্যাক্স ধার্য করে। আর এর ফলে মনিপুরী প্রজাবৃন্দ নিজেদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে ভাবতে শুরু করে এবং একটা ক্ষোভ ক্রমশ: দানা বেঁধে উঠতে থাকে।

মনিপুরি প্রজাবৃন্দ সবচেয়ে বেশী সমস্যার সম্মুখীন হন যখন বৃটিশ সরকার মনিপুরে 'ফ্রি ট্রেড পলিসি' চালু করে। এর আওতায় মনিপুর থেকে বছরে ৩৫,০০০ মণ চাল রপ্তানী করা হয়। ফলে মনিপুরে চালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ক্ষুব্ধ মনিপুরিরা ১৯০৪ সালের ৬ই জুলাই তারিখে খাইরম্বন্দ বাজারের ২৮টি দোকানঘর পুড়িয়ে দেয়। ঐ মাসেরই ১৫ তারিখে Captain Nattal এবং Dulop এর বাংলো বাড়ী রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দেয়। ৪ঠা আগষ্টে আবার আরেকটি বাংলোতে আগুন লাগানো হয়। এভাবেই বৃটিশ শাসনে বিক্ষুব্ধ মনিপুরি প্রজাবৃন্দ হিংসাত্মক প্রতিরোধের পথ বেছে নেয়। আর বৃটিশ সরকারও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদেরকে বন্দী করার উদ্যোগ নেয়।

তাছাড়া আগুনে ভস্মীভূত বাংলোগুলো নিজ খরচে নির্মাণ করে দেয়ার জন্যে ইম্ফাল শহরের মনিপুরী প্রজাদের উপর মি. ম্যাক্সওয়েল হুকুমনামা জারি করেন ৩০শে সেপ্টেম্বর। এই আদেশে মনিপুরিদের ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। শগোলবন্দ এলাকার জনৈক চীংচাবা নাতেক সিংহ ম্যাক্সওয়েল সাহেবের এই অন্যায় আদেশ রহিত করার জন্য আবেদন জানান। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল তার আবেদনে সাড়া নি দিলে তাৎক্ষণিক মূহুর্তে প্রায় ৫০০০ লোকের এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ 'বিচারালয়' প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় এবং ঐ সমাবেশে বৃটিশ সরকারের ঐ আদেশ নাকচ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৃটিশ সৈনরা সমাবেশ ভেঙ্গে দেয় এবং নেতৃস্থানীয় ৬ জনকে বন্দী করে। তারা হলেন-
১. মেঘজিৎ সিংহ (৫৬)
২. থাংকোকপা সিংহ (৫০)
৩. মুতুম সিংহ (৬১)
৪. কালা সিংহ (৫৬)
৫. সেনাচাওবা সিংহ (৩৭) ও
৬. দেবেন্দ্র সিংহ (৩১)।
তারা সবাই ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য এবং তাদেরকে বিচারের পর মনিপুরের বাইরে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বৃটিশ সরকারের এই দমন পীড়নে ক্ষুব্ধ সাধারণ মনিপুরিরা শেষ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিনা পারিশ্রমিকে অগ্নিদগ্ধ বাংলোগুলো পুননির্মাণ করে দিতে বাধ্য হয়।

বৃটিশ বাহিনীর এই ক্রমাগত অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মনিপুরি নারীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ থেকে শুরু হয়ে বেশ কয়েকদিন চলে। আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে গেলে বৃটিশরা মনিপুরের বাইরে থেকে সৈন্য আমদানী করে মনিপুরে সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। এই নারী জাগরণে মূখ্য ভূমিকা পালন করে-
১. ইরেংবম সনাজাওবী দেবী
২. লৈশাংথেম খাথবী
৩. লৈমাপোকপম থবলি এবং
৪. লাইশ্রম জুবতি দেবী।

বৃটিশ সরকার নির্যাতনের পথ বেছে নেয়, অনেক নারী নেত্রীই সরকারী বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে আহত হয়। তবু মনিপুরি নারীদের গড়ে ওঠা আন্দোলন ক্রমশ: তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠার পর সরকারী শাসন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে বাধ্য হয়ে বৃটিশ সরকার তাদের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। আর এভাবেই মনিপুরি নারীদের আন্দোলন প্রাথমিক বিজয় অর্জন করে। মনিপুরি ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টিকারী এই আন্দোলন প্রথম 'নুপী লান' বা মনিপুরি নারী বিদ্রোহ নামে পরিচিতি লাভ করে।

প্রথম নুপী লান বা নারী বিদ্রোহ মনিপুরি নারীদের মধ্যে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। আর এর ফলে বৃটিশ শাসনামলে নানা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মনিপুরি নারীরাই বারে বারে গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ আন্দোলন। মনিপুরে 'ফ্রি ট্রেড পলিসি' চালু হওয়ার পর থেকেই চালের দাম বেড়ে যায়। কারণ এই কর্মসূচীর অধীনে মনিপুর থেকে প্রচুর চাল বাইরে পাঠানো হয়। ১৮৯৭-৯৮ সালে ২৫,২৩০ মণ চাল রপ্তানী করা হয়। পরবর্তী বছর ১৮৯৮-৯৯ সালে এই রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৩৬,৪৩৬ মণ। ১৯২২-২৩ সালে চাল রপ্তানী হয় ৮০,০০০ মণ।১৯২৫-২৬ সালে এই পরিমাণ হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১,৫৫,০১৪ মণ। এভাবে প্রতি বছরে রপ্তানীর এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৩১-৩২ সালে ২,৭৭,৩৮৯ মণ এবং ১৯৩৭-৩৮ সালে ৩,৭২,১৭৪ মণে দাঁড়ায়। কিন্তু জমির পরিমাণ সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। ১৯২৫-২৬ সালে জমির পরিমাণ যেখানে ছিল ১,৭৫,৫৩৭ একর সেখানে ১৯৩৭-৩৮ সালে তা মাত্র ১০,৩২২ একর বেড়ে ১,৮৫,২১৩ একরে দাঁড়ায়। একারণেই উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশী পরিমাণ চাল বাইরে রপ্তানী করা হতো বলে দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং মনিপুরি জনগণের সার্বিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।

এসময় মনিপুরি নারীরা মনিপুর থেকে চাল রপ্তানী বন্ধ করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৩৯ সালে দীর্ঘমেয়াদী খরা এবং ফসলতোলার আগে প্রচন্ড শিলাপাতের কারণে ফসলহানি ঘটে। তারপরও মারোয়ারী/মারওয়ারী ব্যবসায়ীরা কমদামে ধান ক্রয় করে মেশিনে ভাঙিয়ে চাল রপ্তানী করা অব্যাহত রাখে। আগে যেখানে চালের দাম ছিল মণ প্রতি চার আনা সেখানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দু'টাকায় দাঁড়ায়। কেবল দাম আকস্মিক বৃদ্ধিই নয়, চাল প্রায় দুষ্প্রাপ‌্য হয়ে ওঠে। একধরনের দূর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করে। এমনি অবস্থায় 'তেরা কৈথেল' (তেরা বাজার) এর অরিবম চাওবীতোন দেবীর নেতৃত্বে প্রথম একদল মনিপুরি নারী রপ্তানীর জন্য আনা ধান-চাল আটক করে এবং চালের কল বন্ধ করার জন্যে সরকারের কাছে আবেদন জানায়। পরে প্রায় এক হাজার নারী খ্বাইরম্বন্দ বাজারে সমবেত হয়ে পলিটিক্যাল এজেন্ট মি. গিমসনের অফিস ঘেরাও করে এবং চাল রপ্তানীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তারা 'মনিপুর ষ্টেট দরবার' এর প্রসিডেন্ট মি. টি এ শার্প'কে ঘেরাও করে রাখে এবং চালের কল ও রপ্তানী বন্ধ করার জন্য চাপ দেয়।

আন্দোলনকারী নারীদের সংখ্যা ক্রমশ: বাড়তে থাকে এবং দ্রুত ৪,০০০ ছাড়িয়ে যায়। তারা টি এ শার্প'কে টেলিগ্রাম অফিসে নিয়ে যায় নবদ্বীপে অবস্থানরত মহারাজের কাছে জরুরী টেলিগ্রাম বার্তা পাঠিয়ে রপ্তানী বন্ধের জন্য। টেলিগ্রাম বার্তায় তারা আরও জানায় যে তাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত টি এ শার্প, মেজর কামিন্স, মেজর বুলফিল্ড সহ টেলিফোন অফিসের কর্মচারীদেরকে ঘেরাও করে রাখবে। আন্দোলনকারী নারীদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে দ্রুত সেখানে পৌছে য়ায় 'আসাম রাইফেল' এর এক প্লাটুন সৈন্য। কিন্তু নারীরা পিছপা হয়নি। বরং আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ বেঁধে যায়। সৈন্যরা বেয়নেট এবং বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করতে থাকে এবং এর ফলে প্রায় ৩০জন আন্দোলনকারী আহত হয়। এদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা ছিল গুরুতর এবং তাদেরকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

১৪ই ডিসেম্বর তারিখে হৈরোক এবং ওয়াংজিং থেকে ১৮জন নারী নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। এখবর ছড়িয়ে পড়লে পরদিন ১৫ই ডিসেম্বর মনিপুরি নারীরা এক প্রতিবাদ সভা করে এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দাবী করে মিছিল নিয়ে রওয়ানা হয় জেল অভিমুখে। সেখানে জেল গেটে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে আন্দোলনকারী নারীরাও লাঠি হাতে প্রতিরোধ করে।

ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বিচারালয়ের সামনে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশ থেকে পুলিশের ইন্সপেক্টর কর্তৃক একজন নারী নেত্রীর লাঞ্ছিত হওয়া, ১৫ তারিখের মিছিলে লাঠিচার্জ এবং একজন চাল ব্যবসায়ী কস্তুরীর ছেলে কর্তৃক নারী নেত্রীদের বিরুদ্ধে অশোভন উক্তির প্রতিবাদে বিচার দাবী করা হয়। ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে আটককৃত নেত্রীবৃন্দকে বিচারের জন্য কোর্টে নিয়ে আসা হলে আন্দোলনকারীরা সেখানে আক্রমন করে বিচার সভা বানচাল করে দেয়। তারপর একজন বৃটিশ কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে টেলিগ্রাম অফিস থেকে নবদ্বীপে অবস্থানরত মহারাজের কাছে টেলিগ্রাম প্রেরণ করানো হয়। খবর পেয়ে আসাম রাইফেলস এর একদল সৈন্য এসে আন্দোলনকারীদেরকে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সরকারী বাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধের সময় কাংজম সনাজাওবী লৈমা সহ বেশ ক'জন নেত্রী আহত হন।

শুধু তাই নয়, আন্দোলনকারী নারীরা রোড ট্যাক্স, যানবাহনের ট্যাক্স সহ বিভিন্ন ট্যাক্স বন্ধ করা, বহিরাগত ব্যবসায়ীদের বিক্রি করা কাপড় না কেনা, দালালদের কাছে কোন ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি না করাসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে সরকারের প্রতি বিদ্রোহ শুরু করে।

একুশের প্রভাতফেরীতে ঢাকাবাসী মনিপুরি






"আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান একুশে ফেব্রুয়ারী অমর হোক"


মাতৃভাষার স্বীকৃতি ও তাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবীতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃসন্তানদের রক্তদান ও আত্মাহুতির চূড়ান্ত স্বীকৃতি আজকের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কেবল 'বাংলা'ভাষাকে নয়, পৃথিবীর সমস্ত ভাষার অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একুশের চেতনা তাই মানুষের অস্তিত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের মূলমন্ত্র। একুশের এই সংগ্রামে যারা রক্ত ও আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। ইউনেস্কো কর্তৃক নভেম্বর ১৭, ১৯৯৯ তারিখ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর ২১শে ফেব্রুয়ারী ২০০০ সাল হতে অদ্যাবধি প্রতিবছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমার গভীর গভীর শ্রদ্ধার সাথে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে এদিনটিকে পালন করে আসছি।

পৃথিবীর অপরাপর ভাষার ন্যায় মনিপুরি ভাষাও এক প্রাচীন ভাষা। যার প্রাচীন নাম 'মীতেইলোন' বা 'মেইতেই লোন' । এই ভাষার রয়েছে এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সাহিত্য। উৎস বিচারে এই ভাষা মঙ্গোলীয় মহাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং এর উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় ৩৪০০ বছর আগে। প্রাচীনতার দিক থেকে মনিপুরি সাহিত্যের স্থান ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য কর্ম কৃষ্ণ যজুর্বেদের পরেই। মনিপুরি ভাষা সাহিত্যের সৃষ্টি সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ যেমন: ওগ্রী, খম্বাথোইবী ইত্যাদি।

মনিপুরি জনগোষ্ঠী পৃথিবীর অন্যান্যস্থানে বসতিস্থাপন ছাড়াও ঢাকা শহরের তেজগাও অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। কিন্তু কালের ক্ষয়িঞ্চু ধারায় এই জনগোষ্ঠী ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে আজ কেবল স্মৃতি হয়েই ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে স্থানটুকু।

মনিপুরি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে মনিপুরি লিপি প্রবর্তিত হয় মহারাজ পাখংবার শাসনামলে (৩৩-৩১৫ খৃ। তখন বর্ণ সংখ্যা ছিল ১৮টি। পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বার শাসনামলে আরো ৯টি নতুন বর্ণ সংযোজিত হয়। বর্তমানে মোট বর্ণমালার সংখ্যা হচ্ছে ২৭টি। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা পামহৈবার শাসনামলে (১৭০৯-১৭৪৮ খৃ শ্রী শ্রী চৈতন্য প্রবর্তিত 'বৈষ্ণব' ধর্ম তৎকালীন মনিপুর রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্মরুপে গৃহীত হওয়ার পর বাংলালিপি দখল করে নেয় মনিপুরি লিপির স্থান। সেই থেকে মনিপুরি ভাষা বাংলা হরফেই লিখিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি বিলুপ্ত মনিপুরি লিপির পুন:ব্যবহার ও প্রচলন শুরু হয়েছে।





প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহন:

ঘড়ির কাটা যখন ঠিক ৭:০০ ছুই ছুই তখন পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী পলাশীর মোড়-এ জড়ো হতে থাকে ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মনিপুরিরা। হালকা হালকা শীত করছিল। জনলোকারণ্যে একে একে ছেয়ে যায় পলাশী মোড়। শিশু কিশোরদের কপালে, গালে বিভিন্ন লেখা শোভা পাচ্ছিল। কেউবা মাথায় অমর একুশের শহীদ মিনার সম্বলিত বেল্ট কেউবা জাতীয় পতাকা কেউবা স্টিকার লাগিয়ে দাড়িয়ে আছে। অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম এক আনন্দ ছেয়ে যায় মন ও মননে।

তারপর একে একে যখন আমাদের পরিচিত সবাই এসে গেলো তখন আমরা মহান একুশে ফেব্রুয়ারীর সারিবদ্ধ প্রভাতফেরীর লাইনে। আমাদের উঁচু ঝান্ডায় লেখা বড় বড় করে লেখা 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান একুশে ফেব্রুয়ারী অমর হোক', সৌজন্যে 'ঢাকাবাসী মনিপুরি'। আর এই উঁচু ঝান্ডা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল আমারই দুই সহপাঠী বন্ধু।

আমরা যখন শহীদ মিনারের খুব কাছে চলে এলাম তখন সত্যি অন্যরকম এক শীতলতা বিরাজ করছিল মনে। সামনেই স্তুপাকারে (নিবেদিত/অর্পিত)বিশাল ফুলের সমাহার। তারপর আমাদের দুই বন্ধু পুষ্পস্তবক অর্পন করল, আমাদের প্রত্যেকের হাতে এক একটি করে ফুলের তোড়া ছিল, কারো কারো দুটো.. একে একে আমরা সবাই শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম..

তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা সোহরাওর্য়াদি উদ্যানে মিলিত হয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্বের আয়োজন করি। সেখানে অনেক অজানা তথ্যও বেরিয়ে আসে, জানা হয় সবার..